মধুর উপকারিতা সম্পর্কে আমরা বড় ছোট সবাই কমবেশি ধারণা রাখে । মধু অনেক ঔষধি উপাদান সমৃদ্ধ একটি খাদ্য উপাদান । শরীর গরম করার জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি উপাদান । মধুর মধ্যে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে, তবে এতে সাধারণ কোনো চর্বি বা প্রোটিন নেই।
সাধারণত প্রতি ১০০ গ্রাম প্রায় ৩০৪ ক্যালরি শক্তি পেয়ে থাকে। মধু কিনতে গেলে আমাদের সবাই কম-বেশি বিপাকে পড়তে হয়। কারণ সাধারণত মধু খাঁটি নাকি ভেজাল সেটা বোঝার কোন উপায় থাকেনা।
মধু হল সাধারণত মিষ্টি ও ঘন তরল পদার্থ, যা সাধারণত মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে তৈরি করে এবং মৌচাকে সংরক্ষণ করে। মধুতে রয়েছে ঔষধিগুন সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল উপাদান বিদ্যমান।
বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতিতে চিনির থেকেও অধিক হারে মধু ব্যবহার করে থাকেন। আর মধুর বিশিষ্ট গন্ধের জন্য অনেকে চিনির চাইতে মধুকেই পছন্দ করে থাকেন। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধু স্বাদ,রং,সুগন্ধ এবং ঔষধিগুণাবলীর জন্য প্রসিদ্ধ।
সুন্দরবনের বেশীরভাগ মধু কেওড়া গাছের ফুল থেকে উৎপন্ন। সুন্দরবনের মাওয়ালী সম্প্রদায়ের লোকেরা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে এবং তা বিক্রয় করে জীবন নির্বাহ করে। মধুর একটি অন্যান্য গুণ হল এটি কখনো নষ্ট হয় না৷
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মধুর প্রয়োজনীয়তা অনেক। মধুর উপকারিতা এবং কার্যকারীতা বলে শেষ করা যাবে না। তবে মধু যদি আসল না হয়ে ভেজাল যুক্ত হয়, তখন কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আজকে আমরা আপনাদের কাছে মধু চেনার সহজ ১০টি উপায় তুলে ধরব এবং আপনি নিজেও পরীক্ষা করে যাচাই করে নিতে পারবেন কোন মধুটি আসল এবং কোন মধুটি ভেজাল।
১।হাতের বুড়ো আংগুল পদ্ধতিঃ
হাতের বুড়ো আঙুলের পরীক্ষার ক্ষেত্রে সামান্য মধু নিন বুড়ো আঙুলে। দেখুন, এটি অন্যান্য তরলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে কি না। মধু খাঁটি না হলে তা অন্য তরলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আসল মধু ঘন হয়ে আটকে থাকবে। সহজে ছড়াবে না। আবার একটু বেশি পরিমাণ মধু নিয়ে বুড়ো আঙুল উল্টো করে ধরে রাখলে তা সহজে ফোঁটা আকারে পড়বে না।
২।পানি পদ্ধতিঃ
এ পদ্ধতিতে আপনাকে এক গ্লাস পানির মধ্যে এক চামচ মধু মেশাতে হবে। পানির মধ্যে আস্তে আস্তে নাড়ুন। যদি দেখেন মধুর পানির সাথে মিশে যাচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে এটি আসল মধু না। আর যদি মধু আসল হয়ে থাকে, তাহলে মধু পানিতে মিশে যাবে না, বরং ছোট ছোট দলা আকারে পানির মধ্যে ছড়িয়ে যাবে।
৩।পিঁপড়া পদ্ধতিঃ
পিঁপড়া মিষ্টি পছন্দ করলেও মধু পছন্দ করে না। এর হয়তো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এখন এক টুকরো কাগজে কিছু মধু লাগিয়ে যেখানে পিঁপড়া আছে সেখানে রেখে দিন। যদি পিঁপড়ারা এই কাগজের দিকে আকৃষ্ট হয়, এবং এটিকে ঘিরে ধরে, তাহলেই বুঝতে হবে এই মধূ আসল না! আর যদি পিঁপড়ারা আকৃষ্ট না হয়, আপনিই বুঝতে পারবেন এটা আসল মধু।
৪।কাপড়ে দাগ পদ্ধতিঃ
এ পদ্ধতিতে পরীক্ষার জন্য প্রথমেই এক টুকরা সাদা কাপড় নিন যেটি আপনি হয়ত আর পরে ব্যবহার করবেন না। এবার কাপড়ে সামান্য মধু সরাসরি লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। যদি পানিতে ধুয়ে ফেললে দাগ চলে যায়, তাহলে বুঝবেন এটি আসল। আবার নকল মধুতে থাকা জিনিষ আপনার কাপড়ে দাগ ফেলবে, যা আসল মধু করে না।
৫।অগ্নি পদ্ধতিঃ
আসল মধু চেনার ক্ষেত্রে আগুন ও বিশেষভাবে সাহায্য করে। খাঁটি মধু কিন্তু দাহ্য পদার্থ। তবে মধুতে আগুন জ্বালানোর আগে সাবধান থাকবেন। নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিপূর্ণ করতে হবে। পরীক্ষা অতি সাধারণ। ম্যাচের একটা কাঠি মধুতে চুবিয়ে নিন। এবার এই কাঠি জ্বালাতে ম্যাচবক্সে আঘাত করুন। জ্বলে উঠলে মধু নিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। আর মধুতে ভেজাল থাকলে আগুন জ্বলবে না।
৬।ডিপ ফ্রিজ পদ্ধতিঃ
মধু একটি কিছুতে নিয়ে ডিপ ফ্রিজে একদিন রেখে দিন। একদিন পর মধু বের করে দেখুন, যদি আসল মধু হয়, তাহলে এটি জমবে না। যদি পুরোটা জমে যায় কিংবা কিছু অংশ জমে যায় তাহলে বুঝবেন যে এটিতে ভেজাল আছে। আসল মধু ঠাণ্ডায় জমে যায় না।
৭।ভিনেগার পদ্ধতিঃ
ভিনেগারের পরীক্ষার জন্যে এক টেবিল চামচ মধু, সামান্য পানি আর সেই মিশ্রণে দুই-তিন ফোঁটা ভিনেগার দিন। যদি এই মিশ্রণ ফোমের মতো ফেনিল হয়ে ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে মধুতে অন্য কিছু মেশানো রয়েছে।
৮।তাপমাত্রা পদ্ধতিঃ
তাপমাত্রার পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যাবে খাঁটি মধুতে তাপ দিলে তা খুব দ্রুত কেরামেলের মতো হয়ে যাবে। এটা ফোমের মতো ফেনিল হবে না। কিন্তু ভেজাল মধু কেরামেলের মতো ফেটে ফেটে যাবে না। এতে কেবল বুদবুদ উঠবে।
৯।মেথিলেটেড স্পিরিট পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রথমেই আপনাকে যে কোনো সাইন্স ইকুইপমেন্ট স্টোর থেকে মেথিলেটেড স্পিরিট আনতে হবে। পরীক্ষাটি অত্যন্ত সতর্কভাবে করবেন এবং হাত দিয়ে সরাসরি ধরবেন না। সমান পরিমাণে মেথিলেটেড স্পিরিট এবং মধু নিতে হবে এবং নাড়তে থাকতে হবে। যদি দেখা যায় মধু তলানী হিসাবে জমে যাচ্ছে, তাহলে বুঝবেন মধু আসল। আর যদি স্পিরিটের রং সাদাটে হয়ে আসে, তাহলে বুঝবেন মধুটি নকল।
১০।ব্লটিং পেপার পদ্ধতিঃ
এই পরীক্ষার জন্যও আপনাকে কোনো সায়েন্স স্টোর থেকে ব্লটিং পেপার কিনে আনতে হবে। ব্লটিং পেপারের উপরে কয়েক ফোঁটা মধু নিন। যদি মধু ব্লটিং পেপারের ভিতরে আস্তে আস্তে মিশে যায়, বুঝবেন এটি আসল মধু নয়। কারণ আসল মধু ব্লটিং পেপারকে ভেজায় না।
এতোক্ষন আমরা জানলাম মধু আসল নাকি ভেজাল সেগুলো পরীক্ষণের পদ্ধতি। এবার আমরা জানবো মধু ব্যবহারের উপকারীতা।
মেয়েরা সাধারণত অন্যান্য বিষয় থেকে নিজের প্রতি সচরাচর প্রাধ্যান্য বেশি দেয়। যেমন রূপ চর্চা, সুন্দর চুল, সুন্দর স্বাস্থ্য ইত্যাদি। তবে এই রূপ চর্চার এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অধিকভাবে সাহায্য করে খাঁটি মধু। অর্থাৎ মধু ব্যবহার করেই আমরা দৈনন্দিন বিভিন্ন রকমের ত্বকের যত্নের কাজ করতে পারি। দেখে নেই মধুর সাহায্যে বিশেষ কয়েকটি ত্বকের যত্নের উপকারিতা।
১। সমপরিমাণ মধু ও আমন্ড গুঁড়ো এক সঙ্গে মিশিয়ে ত্বলে লাগিয়ে নিন। কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। ত্বক উজ্জ্বল ও কোমল হবে।
২।ব্ল্যাকহেডসের সমস্যা দূর করতে ব্যবহার করুন মধু। ১ চা চামচ বেকিং সোডার সাথে ২ চা চামচ মধু মিশিয়ে স্ক্রাবার তৈরি করে নিন। ঘষে ঘষে লাগান ত্বকে। ত্বকের মৃত কোষ ঝরে যাওয়ার পাশাপাশি দূর হবে ব্ল্যাকহেডস।
৩।হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা মধু নিয়ে ত্বকে সরাসরি ম্যাসাজ করুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
৪।মধু প্রাকৃতিক ময়শ্চারাইজার। ত্বকে আর্দ্রতা ফেরাতে মধুর সঙ্গে অলিভ অয়েল মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। তারপর শুষ্ক অংশে ওই মিশ্রণ লাগিয়ে অপেক্ষা করুন ২০ মিনিট। ভেজা সুতি কাপড় দিয়ে ত্বক মুছে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৫।নারকেল তেলের সঙ্গে সামান্য মধু মিশিয়ে নিন। চোখের আশেপাশের অংশ বাদে বাকি ত্বকে লাগান। কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন ৫ মিনিট পর। ত্বকের প্রসাধনী দূর হবে। পাশাপাশি বন্ধ লোমকূপ খুলবে।
৬।এক মগ পানিতে মিশিয়ে নিন আধা কাপের চেয়ে একটু বেশি পরিমাণ মধু। শ্যাম্পুর পর কন্ডিশনার ব্যবহারের পরিবর্তে এই মিশ্রণ ঢেলে দিন চুলে। আঙুল চালিয়ে হালকা ম্যাসাজ করুন। এরপর ভালো করে ধুয়ে নিন চুল।
৭।২ চা চামচ টক দই ও ৩ চামচ মধু মিশিয়ে হেয়ার প্যাক বানিয়ে নিন। গোসলের আগে মিশ্রণটি চুলে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিট। ভেষজ শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিন।
৮।শীতকালে আমাদের অনেকের পায়ের গোড়ালি ফেটে যায় এবং ত্বকের রুক্ষতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে গোড়ালি তে মধু দিয়ে ম্যাসাজ করু। এটি অনেক উপকার করে থাকে।
৯।মধুতে থাকা গ্লুকোজ অক্সিডেজ চুলে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড প্রদান করে থাকে যা চুলের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে চুল অনেক বেশি হাইলাইট করে তোলে। এর জন্য এটি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন।
১০।বয়সের ছাপ ধূর করে এর প্রোবায়োটিক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পুষ্টি উপাদান এবং নির্যাস একসঙ্গে কাজ করে ত্বককে মসৃণ, টানটান ও সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। মধু ত্বককে তৈলাক্ত না করেই ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে। মধু সম্পূর্ণভাবে বলিরেখা কমাতে না পারলেও এর দৃশ্যতা কমাতে সহায়তা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের ক্ষয় পূরণ করে। ফলে ত্বকে সহজে বয়সের ছাপ দেখা দেয় না।
এবার আমরা জেনে নেবো সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে মধুর উপকারিতা।
১।হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। রক্তনালি প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে এবং হৃদপেশির কার্যক্রম বৃদ্ধি করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
২।দাঁতকে পরিষ্কার ও শক্তিশালী করে। এবং দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে।
৩। মধুতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা, যা দেহকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের হাত থেকে রক্ষা করে।অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও কোষকে ফ্রি রেডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
৪।মধুর ক্যালরি রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়, ফলে রক্তবর্ধক হয় যারা অর্থাৎ রক্ত স্বল্পতায় বেশি ভোগে বিশেষ করে মহিলারা, তাদের জন্য নিয়মিত মধু সেবন অত্যন্ত ফলদায়ক।
৫।গ্লাইকোজেনের লেভেল সুনিয়ন্ত্রিত করে।
৬।আন্ত্রিক রোগে উপকারী। মধুকে এককভাবে ব্যবহার করলে পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগের উপকার পাওয়া যায়। আলচার ও গ্যাস্ট্রিক রোগের জন্য উপকারী।
৭।দুর্বল শিশুদের মুখের ভেতর পচনশীল ঘায়ের জন্য খুবই উপকারী। শরীরের বিভিন্ন ধরনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।
৮।ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ মধু স্নায়ু এবং মস্তিষ্কের কলা সুদৃঢ় করে।
৯।মধুতে স্টার্চ ডাইজেস্টি এনজাইমস এবং মিনারেলস থাকায় চুল ও ত্বক ঠিক রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
১০।শরীর ও ফুসফুসকে শক্তিশালী করে।গলা ব্যথা, কাশি-হাঁপানি এবং ঠাণ্ডা জনিত রোগে বিশেষ উপকার করে। শিশুদের প্রতিদিন অল্প পরিমাণ মধু খাওয়ার অভ্যাস করলে তার ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি, জ্বর ইত্যাদি সহজে হয় না।