কিডনি পরিষ্কার করে এই ৯ খাবার

কিডনিতে-পাথরের-কারণ

কিডনি, আমাদের শরীরের সেই গোপন বীর যারা আমাদের স্বাস্থ্যেকে ভাল রাখতে নিরবে কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু কতটা জানি আমরা এই জীবন রক্ষাকারী অঙ্গ সম্পর্কে?নিজের অজান্তেই ভুল খাবার গ্রহণ করে আমরা আমাদের এই জীবন রক্ষাকারী অঙ্গটির ক্ষতি করছি না তো ? 

আমাদের নিজেদের সুস্থ রাখার জন্য কিডনিকে সুস্থ রাখাটা অত্যন্ত জরুরি । তাই আমাদের খাদ্যাভ্যাস এবং খাবারের মধ্যে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় খাবার রাখা উচিত যেগুলো কিডনিকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করবে । 

আজকে চলুন জেনে নিব কিডনিকে সুস্থ ও পরিষ্কার রাখার জন্য কোন কোন খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । 

কিডনি পরিষ্কার করে এই ৯ খাবার 

আমাদের শরীরের সুস্থতায় সবুজ শাকসবজির অবদান অনস্বীকার্য। তবে কিডনি ভালো রাখতে সবুজ শাকসবজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  

১। কিডনি পরিষ্কার রাখতে পর্যাপ্ত পানি পানঃ 

কিডনি আমাদের শরীরের ফিল্টারিং সিস্টেম, কিডনি সুস্থ থাকলেই আমরা সুস্থ। আর পানিই কিডনির সেরা বন্ধু। এটি শুধু আপনাকে হাইড্রেটেড রাখে না, বরং কিডনিকে কার্যকরী ও পরিস্কার রাখতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। 

শীতকালে-পানি-পান-করার-উপকারিতা

পানি কিডনিতে জমে থাকা টক্সিন ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে। যত বেশি পানি পান করবেন, তত দ্রুত এই বিষাক্ত পদার্থগুলি শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে।

পর্যাপ্ত পানি পান কিডনিতে জীবাণু জমে থাকাকে বাধা দেয় এবং মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। মূত্র ঘন হয়ে গেলে কিডনি পাথরের ঝুঁকি বাড়ে। পানি মূত্রকে পাতলা করে কিডনিতে পাথর তৈরির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। কিডনির ঠিকমতো কাজ করার জন্য সুস্থ রক্তচাপ গুরুত্বপূর্ণ। পানি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে যা কিডনির উপর চাপ কমায়।

কিডনি পরিস্কার রাখতে কি পরিমাণ পানি পান করা উচিত?

আপনার প্রতিদিন কতটা পানি প্রয়োজন তা বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন শরীরের ওজন, বয়স, কার্যক্রমের মাত্রা ইত্যাদি। তবে সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। 

২। কিডনি পরিষ্কার রাখতে ফল-মূলঃ

ফল-মূল প্রকৃতির অমূল্য উপহার যা কিডনি যত্নে , কিডনি পরিস্কার রাখতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে।

যেভাবে ফল-মূল কিডনিকে পরিষ্কার রাখেঃ

আপেল খাওয়ার উপকারিতা

তরমুজ, স্ট্রবেরি-র মতো ফল জল সমৃদ্ধ, যা কিডনিকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে। আপেল, ব্লুবেরি-তে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিডনির ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে। এছাড়াও ক্র্যানবেরি জাতীয় ফল মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করে, কিডনির উপর চাপ কমায়। কলা, পেঁপে, আঙ্গুর-এর পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। চেরি, আনারস, টমেটো-র অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য কিডনিতে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

কিডনির জন্য ভালো ফল-মূলঃ

  • ফল: তরমুজ,আপেল, কলা, পেঁপে, আঙ্গুর, চেরি, ব্লুবেরি, শসা , স্ট্রবেরি , আনারস ইত্যাদি ।  
  • মূল: বিট, গাজর, ইত্যাদি । 

৩। কিডনি পরিষ্কার রাখতে প্রতিদিন সবুজ শাকসবজিঃ

সবুজ শাকসবজি প্রাকৃতিক ডিটক্সিফায়ার হিসেবে কাজ করে। পালং শাক, লাউ শাক, ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুস ইত্যাদি শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফাইবার থাকে। এগুলো শরীর থেকে অতিরিক্ত টক্সিন ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে, যা কিডনির উপর চাপ কমিয়ে দেয়।

দ্রুত-উপায়ে-ওজন-কমানোর-উপায়

উচ্চ রক্তচাপ কিডনির জন্য ক্ষতিকর। প্রায় শাক সবজিতে ভিটামিন সি, কে, ফাইবার , ফলিক এসিড ও পটাশিয়াম ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে থাকে। এগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ফলে কিডনির উপর চাপ কমে।

কিডনিতে প্রদাহের ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। শাক সবজিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, ফলে কিডনি সুস্থ থাকে।

কিডনিতে-পাথরের-কারণ
কিডনিতে পাথরের কারণ

কিডনি স্টোন একটি বেদনাদায়ক সমস্যা। সবুজ শাকসবজি গ্রহণে কিডনি স্টোন প্রতিরোধ হয় । 

শাকসবজি খাবার সময় যা খেয়াল রাখা জরুরীঃ 

  • প্রতিদিন অন্তত 2-3 কাপ সবুজ শাকসবজি খান।
  • বিভিন্ন ধরণের সবুজ শাকসবজি খান।
  • শাকসবজি রান্না করার সময় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করবেন না।
  • শাকসবজি ভেজে বা সিদ্ধ করে খান।
  • শাকসবজিতে লবণ কম ব্যবহার করুন।

৪। কিডনি পরিষ্কার রাখতে রসুনঃ

রসুনের উপকারিতা

রসুনে থাকা অ্যালিসিন নামক উপাদান শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে, যা কিডনির উপর থেকে চাপ কমায়। রসুন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে, যা কিডনির উপর চাপ কমায়। রসুনে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান কিডনির প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

কিডনির-ব্যথা-দূর-করতে

ডায়াবেটিস কিডনির জন্য ক্ষতিকর। রসুন রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।  

রসুন খাবার সময় যা খেয়াল রাখা জরুরীঃ 

  • খালি পেটে প্রতিদিন কাঁচা ১ কোয়া রসুন খান এতে কিডনি এটি কিডনি পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি হার্টকেও ভালো রাখবে  । 
  • অতিরিক্ত রসুন খেলে পেট খারাপ, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা হতে পারে। তাই সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
দুধ-না-খাওয়ানোর-অভ্যাসের-কারণে-স্তন-ক্যান্সারে-আক্রান্ত
  • গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের রসুন খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৫। কিডনি পরিষ্কার রাখতে লেবুঃ

শরীরের ওজন কমাতে লেবুর উপকারিতা

লেবুতে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে, ফলে কিডনির চাপ কমে। লেবুর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করে, যা পরোক্ষভাবে কিডনির উপর চাপ কমায়। লেবুর পটাশিয়াম সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। 

লেবুর অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান কিডনিতে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

লেবু খাবার সময় যা খেয়াল রাখা জরুরীঃ 

  • প্রতিদিন সকালে গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। এটি শরীর ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে।
  • সালাদ, স্যুপ বা রান্নায় লেবুর রস ব্যবহার করুন।
পিরিয়ডের-সময়-গ্রিন-টি
  • লেবুর চা পান করতে পারেন।
  • অতিরিক্ত লেবু খেলে পেট খারাপ, অম্বল, দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। তাই সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
  • লেবুর রস সরাসরি না খেয়ে পানিতে মিশিয়ে খাওয়া ভালো।
  • কিডনিতে ইতিমধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে, লেবু খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৬। কিডনি পরিষ্কার রাখতে অলিভ অয়েলঃ

অলিভ অয়েলে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান ,অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিডনি পরিস্কারের কাজ করে ।  এছাড়াও অলিভ অয়েল খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়, যা কিডনির জন্য উপকারী।

চুলের-গোঁড়া-শক্ত-করতে-অলিভ-অয়েল-ও-আমলকী

অলিভ অয়েল খাবার সময় যা খেয়াল রাখা জরুরীঃ 

  • রান্নায় অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারবেন । 
  • সালাদে অলিভ অয়েল করতে পারবেন ।
  • অতিরিক্ত অলিভ অয়েল খেলে ওজন বৃদ্ধি হতে পারে। তাই সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
  • বাজারে বিভিন্ন ধরনের অলিভ অয়েল পাওয়া যায়। রান্নার জন্য Extra Virgin Olive Oil এবং Extra Light Olive Oil ব্যবহার করা যেতে পারে।

৭। কিডনি পরিষ্কার রাখতে আদাঃ

কিডনিকে পরিষ্কার রাখতে যে সকল খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে আদা একটি ।  আদায় থাকা জিনজেরোল নামক উপাদান শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়। আদার অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান কিডনিতে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আদা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে । আদা মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে কিডনির উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

ওজন-কমাতে-আদা

আদা খাবার সময় যা খেয়াল রাখা জরুরীঃ 

  • প্রতিদিন সকালে গরম জলে আদা কুচি বা আদা চা পান করুন।
  • রান্নায় আদা ব্যবহার করুন।
  • সালাদে কাঁচা আদা কুচি দিতে পারেন।
  • গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের আদা খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • অতিরিক্ত আদা খেলে পেট খারাপ, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা হতে পারে। তাই সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। 

৮। কিডনি পরিষ্কার রাখতে চর্বিযুক্ত মাছঃ

চর্বিযুক্ত মাছ কিডনিকে পরিস্কার ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।  রক্তচাপ কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, চর্বিযুক্ত মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যার ফলে কিডনি রোগের ঝুঁকি কমে যায় ।

পিত্তথলির-পাথর

এছাড়াও চর্বিযুক্ত মাছে থাকা HDL (ভালো) কোলেস্টেরল LDL (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা কিডনির জন্য উপকারী। আর চর্বিযুক্ত মাছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে, যা কিডনির কোষের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।  

কিছু জনপ্রিয় চর্বিযুক্ত মাছ: 

  • রুই
  • টুনা
  • স্যামন
  • কাতলা 
  • মৃগেল
  • বেলে

কিভাবে চর্বিযুক্ত মাছ খাবেন:

  • সপ্তাহে অন্তত দুইবার চর্বিযুক্ত মাছ খাওয়ার চেষ্টা করুন।
  • ভাজার পরিবর্তে রান্না, পোড়ানো বা ঝোল দিয়ে রান্না করুন।
  • অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাছ খেলে ওজন বৃদ্ধি হতে পারে। তাই পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। 
  • কিডনির সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাছ খাবেন। 

৯। কিডনি পরিষ্কার রাখতে হলুদঃ

ত্বক-ফর্সা-করতে-হলুদ

প্রতিদিন সকালে গরম জলে হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে পান করুন। এতে কিডনি পরিষ্কার হয়ে যাবে হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন নামক উপাদান প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা কিডনির জন্য উপকারী। হলুদ রক্তের উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে কিডনিকে ভালো রাখতে সাহায্য করে । 

হলুদেরর উপকারিতা

আমাদেরকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদের দেহের মধ্যে যে কয়েকটি অঙ্গ মুখ্য ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে একটি হলো কিডনি  । এক কথায় কিডনিকে আমাদের দেহের অদৃশ্য সুপারহিরো বলা যায়  । আমাদের দেহকে সুস্থ রাখার জন্য এটি অসাধারণ কাজ করে  । আর এই নয় ধরনের খাবারগুলো যদি আপনারা নিয়মিত খান তাহলে আপনার কিডনি থাকবে খুব যতনে  ।  

কিডনি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ জীবনযাপন, সঠিক খাবার নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে আমরা আমাদের কিডনিকে সুস্থ রাখতে পারি। মনে রাখুন, সুস্থ কিডনি সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি!  ।